মানুষ ও পিঁপড়া: প্রসঙ্গ পরিচয়


সরল জিজ্ঞাসা, গভীর বিষয়

পিঁপড়া সমাজবদ্ধ জীব। সামাজিক প্রাণী। পিঁপড়া বা পিপীলিকা ফর্মিসিডি (Formicidae) গোত্রের অন্তর্গত সামাজিক জীব। এদের ঘনিষ্ঠ প্রজাতি বোলতা ও মৌমাছি। সকলে একই বর্গ হাইমেনপ্‌টেরার (Hymenoptera) অন্তর্গত। পিঁপড়া, বোলতা বা মৌমাছি সবসময় দলে থাকে। দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা বা ওড়াওড়ি করে। তাদের মধ্যে কাজের সম্বন্ধ ও সহযোগিতাও আছে; নিজেরা পতঙ্গ না হলেও পিঁপড়াদের বোলতা ও মৌমাছির মতো পিঁপড়ার দললীয় জীবন যাপনের বৈশিষ্ট্য আমরা বুঝতে পারি। দলে থেকে খাদ্য সংগ্রহের জন্য কাজ না করলে এবং নিজেদের প্রজাতি উৎপাদনে তৎপর না থাকলে তারা প্রকৃতিতে টিকে থাকতে পারত না। দলে থাকা এবং কাজের সম্বন্ধ চর্চা একদিকে পিঁপড়ার স্বভাব; এই স্বভাব অতিশয় প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক। অন্যদিকে মনে হয় স্বভাব বা প্রকৃতির অতিরিক্ত একপ্রকার সামাজিকতা। প্রাণী বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা জীবের আচরণ নিয়ে কাজ করেন তারাও অনেক সময় এই দলবদ্ধতা কিম্বা পারস্পরিক কাজের সহযোগিতাকে ‘সমাজ’ বলে থাকেন। বলেন, পিঁপড়াগণ সামাজিক জীব।

‘সমাজ’ কথাটা এই ক্ষেত্রে আমরা কিভাবে ব্যবহার করি এবং মানুষের সমাজের সঙ্গে পিঁপড়ার সমাজের পার্থক্য কোথায় এই জিজ্ঞাসা দিয়েই এই বইটি শুরু করছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা রাজনীতি, রাষ্ট্র ও ক্ষমতা নিয়ে আলোচনায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করবো। যে জিজ্ঞাসা থেকে এই লেখাটির শুরু, তাকে আরও সুনির্দিষ্ট করবার জন্য বলতে পারি ‘সমাজ’ কথাটা আমাদের কাছে যতো নিশ্চিত অর্থ বহন করে আদৌ তা নিশ্চিত কোন ধারণা কি? আসলেই 'সমাজ' মানে কী?

বলাবাহুল্য ‘সমাজ'  নামক ধারণার সঙ্গে সমাজতন্ত্র, সমাজবাদ ইত্যাদি ধারণাও জড়িত। ‘সমাজ’ সম্পর্কে আমাদের ধারণা যদি অস্পষ্ট হয় তাহলে সমাজতন্ত্র, সমাজবাদ প্রভৃতি ধারণাও অপরিচ্ছন্ন হতে বাধ্য; বিশেষত যেসব ধারণার সঙ্গে 'সমাজ' সরাসরি বা প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত। 'সমাজ' কথাটার অর্থ নিষ্পন্ন করা গেলে হয়তোবা আমরা 'সমাজবাদ', 'সমাজতন্ত্র', 'কমিউনিজম' এমনকি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালপর্বে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ধারণা 'উম্মাহ' বা 'বিশ্বসমাজ'-এর বৈপ্লবিক তাৎপর্য বোঝার ক্ষেত্রে খানিক অগ্রসর হতে পারব; আফসোস, যে 'উম্মাহ' এখনো ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মীয় জাতিবাদের খিলকার মধ্যে আবৃত হয়ে রয়েছে। এমনকি আমরা আশা করি নদিয়ার ভাবচর্চায় 'গোষ্ঠ', কথাটির তাৎপর্য বোঝার সদর দরজা খুলবার চাবিও 'সমাজ' ধারণাটি পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে আমরা পেয়ে যেতে পারি। নানান তন্ত্রবাদী ও বাউলিয়ানার মধ্যে নদিয়ার ভাবুকতার সকল অর্জনই হাবুডুবু খাচ্ছে। বাংলাদেশে আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভাবচর্চার ইতিহাসের অনেক উপাদানই আমাদের কাজে লাগতে পারে। না, সম্ভবত ঠিক বলিনি। বরং বলা উচিত পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে বাংলাদেশে আমাদের রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ণয়ের জন্য 'সমাজ' কথাটিকে বৈপ্লবিক জিজ্ঞাসার অধীনস্থ করতে পারার ক্ষমতা অর্জনের ওপর আমাদের ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই নির্ভর করছে।

তাহলে বোঝা যাচ্ছে ‘সমাজ’ সম্পর্কে আমাদের নির্বিচার অনুমানকে জিজ্ঞাসা এবং প্রশ্নাত্মক করে তোলা গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। নতুন সমাজ গড়া কিম্বা উম্মাহ কায়েম নিয়ে আমরা কথা বলি। কিন্তু এই সকল বিষয়ে আমাদের চিন্তা অস্পষ্ট এবং অপরিচ্ছন্ন। ফলে আমরা আসলে নতুন সমাজ গড়া বলতে কী বোঝাই, কিম্বা উম্মাহ বা বিশ্বসমাজ ধারণাগুলোর মানে কী সেই সব আমাদের নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়। 'বিশ্ব সমাজ' নিয়ে ভাববার সমূহ বাস্তবতা থাকা সত্ত্বেও 'উম্মাহ' কথাটা এখনও একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জাতিবাদী আকাংখা হয়ে রয়েছে; সামাজিক মানুষের সার্বজনীন আকাঙ্খা হয়ে উঠতে পারছে না। বিষয়টির জটিলতা সম্পর্কেও আমরা যারপরনাই অজ্ঞ। অজ্ঞতা মোচনের জন্য অজ্ঞতাকে চিহ্নিত করা অতিশয় দরকারি কাজ।

এই পরিস্থিতি মনে রেখে 'সমাজ' সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে একালের পাশ্চাত্য দর্শনের কিছু তর্কের সঙ্গে আমরা প্রথমে পরিচিত হবো। কারণ পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে 'সমাজ' সংক্রান্ত দার্শনিক বিচার স্থানীয় নয়, বরং বৈশ্বিক। কিছ তর্ক পুরানা। আবার কিছু তর্ক একদমই নতুন। এখন তা আরও তীব্র হয়েছে। সেই তর্কের হদিস নেওয়া এবং বাংলাদেশের বাস্তবতায় সমাজ, রাজনীতি ও ক্ষমতা নিয়ে নতুন ভাবে ভাববার সামর্থ অর্জনই আমাদের উদ্দেশ্য।

পিঁপড়াকে আমরা ‘সামাজিক’ বলি কারন দলবদ্ধ কিম্বা দলাবদ্ধতাকেই আমরা 'সমাজ' বলে ধারণা করি। পিঁপড়াদের আমরা সেভাবেই দেখি। 'সমাজ' সম্পর্কে আমাদের আগাম অনুমান বা ধারণা আমরা পিঁপড়াদের ওপর প্রয়োগ করি। আমরা দেখি পিঁপড়া মানুষের মতোই একেকজন পরস্পর থেকে আলাদা। কিন্তু যা কিছু তারা করে সেটা অনেকে মিলে করে; অর্থাৎ সেটা সম্পাদন করে এক সঙ্গে, দলবদ্ধ ভাবে। দলবদ্ধতাকেই ‘সামাজিক’ বলে আমরা ধারণা করি। এই উপলব্ধি থেকে সমাজ সম্পর্কে আমাদের দ্বিতীয় ধারণা দানা বাঁধে: 'সমাজ' বলতে আমরা এক ও অনেকের মধ্যে এক প্রকার সম্বন্ধ অনুমান করি। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধ যেমন, ভাবি যে পিঁপড়ার সঙ্গে পিঁপড়ার সম্বন্ধও মানুষের মতোই। তাই পিঁপড়ার ক্ষেত্রেও 'সমাজ' কথাটা খাটাই।

তবে এক ও অনেকের মধ্যে সম্বন্ধের ধারণা অনুমান মাত্র নয়। কারণ পিঁপড়া নিয়ে গবেষণা করলে সেই সম্বন্ধের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমরা গবেষণা করতে পারি। এই সম্বন্ধের মধ্যে রহস্যের কিছু নাই। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়েই আমরা বুঝতে পারি পিঁপড়া ‘এক’ এবং ‘অনেক’-এর মধ্যে সম্বন্ধ রচনা করেই তার কাজ সম্পাদিত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই সম্বন্ধকে আমরা 'প্রাকৃতিক' বলব, নাকি 'সামাজিক' আখ্যা দেবো সেটাই হচ্ছে তর্কের বিষয়।

পিঁপড়া সমাজবদ্ধ হয়ে এক সঙ্গে থাকে, চলাফেরা করে। জীব হিসাবে তারা এক সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে; প্রাকৃতিক সম্বন্ধ স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রজাতিগত উৎপাদনও সম্পন্ন করে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা বুঝি পিঁপড়ার সামাজিক সম্বন্ধের বৈশিষ্ট্য একান্তই জীবমূলক। অর্থাৎ প্রজাতি পুনরুৎপাদনের তাগিদ আর বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সংগ্রহের পেছনে পিঁপড়ার জৈবিক প্রবৃত্তি কাজ করে। এক ও অনেক পিঁপড়ার সম্বন্ধকে অতএব আমরা জৈবিক প্রকৃতির অধিক কিছু গণ্য করি না। এই অনুমান থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পিঁপড়ার সামাজিক প্রকৃতি তার জীব চরিত্র বা জৈবিক প্রবৃত্তি থেকে ভিন্ন কিছু নয়। খেয়াল করলে আমরা দেখব যে ‘প্রকৃতি’, ‘স্বভাব’, জীব’ ইত্যাদি ধারণা এখানে অদলবদল করে ব্যবহার হচ্ছে। অর্থাৎ শব্দগুলোর মানে পরিচ্ছন্ন নয়। কিন্তু বিচারমূলক দার্শনিক আলোচনায় খেয়ালখুশি মতোন শব্দ ব্যবহার চলে না। সেই ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরী। কিন্তু দার্শনিক পর্যালোচনার ধারা বিকশিত হয় নি বলে সরল ও সহজ বিষয় নিয়ে আলোচনাও বাংলা ভাষায় এখনও কঠিন।

মানুষও একেকজন একা, পরস্পর থেকে আলাদা, অথচ কেউই সমাজের বাইরে বাস করে না। তাদের জীব-জীবনের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন পিঁপড়া থেকে আলাদা কিছু নয়। নিজ নিজ শরীরের খাদ্য ও পুষ্টি জোগানো এবং মনুষ্য প্রজাতিকে বর্তমান রাখার জন্য সন্তান সন্ততি উৎপাদনের দিক থেকে বিচার করলে মানুষের জীবন আর পিঁপড়ার জীবনে ফারাক নাই। কারো একা বাস করবার সুযোগ নাই, পরস্পরের সঙ্গে তারা কোন না কোন ভাবে সম্পর্কিত। প্রাকৃতিক ভাবে টিকে থাকার জন্যই পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা এবং এক সঙ্গে কাজ করা অনিবার্য। তাই মানুষও পিঁপড়ার মতোই সমাজবদ্ধ, পিঁপড়ার মতোই সামাজিক।

দেখা যাচ্ছে জীব হিসাবে মানুষের সঙ্গে পিঁপড়ার মিল বেশ গভীর। উভয়ের মধ্যে মিলের দিকটাই আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। কিন্তু খুবই নির্দোষ আর শিশুতোষ হলেও একটি জিজ্ঞাসা আমরা এড়াতে পারি না: যদি তাই হয়, তাহলে পিঁপড়া কেন ‘পিঁপড়া’ আর ‘মানুষ’ কেন ‘মানুষ’? কোথায় তাদের পার্থক্য? কিম্বা আদৌ কোন ফারাক আছে কি? এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যে, যারা চিন্তা করতে ভালবাসে, ভাবের চর্চা বা দার্শনিক বিচারের আকুতি যাদের মধ্যে প্রবল, তাদের মধ্যে জাগে। এড়ানো যায় না। এই ধরনের সরল জিজ্ঞাসাই আমাদের বিষয়ের গভীরে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যায়।

শিশুতোষ তর্ক

ব্যক্তিতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজ বিচার করতে বসে কার্ল মার্কস এই স্বীকারোক্তি দিয়েই শুরু করেছিলেন যে আধুনিক সমাজে মানুষকে একা এবং পরস্পর থেকে আলাদা ও বিচ্ছিন্ন মনে হয় এবং মানুষও নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন ব্যক্তি গণ্য করে, কিন্তু সেটা আদতে ঠিক না। মানুষ আসলে ‘সামাজিক’: পিঁপড়ার মতোই যুগপৎ একা এবং অনেক। আধুনিক কালে মানুষ 'ব্যক্তি' হিশাবে যে বিশেষ ধরণের মানুষ দেখছে এবং নিজেকেও সেই বিশেষ মানুষ ভেবে নিজেকে সমাজ বিচ্ছিন্ন 'ব্যক্তি' গণ্য করছে, এই ভাব হঠাৎ পয়দা হয় নি, আর্থ-সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়েই এর আবির্ভাব ঘটেছে। আধুনিক 'বুর্জোয়া' বা ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজের উদ্ভব ঘটার মধ্য দিয়ে সমাজ বিচ্ছিন্ন একা মানুষের ধারণা পয়দা হয়েছে।  প্রাচীন, পুরানা, প্রাক-পুঁজিতান্ত্রিক কিম্বা সামন্ত সমাজের ভাঙন ও বিলীন হবার পর ব্যক্তিবোধের আবির্ভাব এবং ক্রমে ক্রমে এই বাক্তিতান্ত্রিকতা সর্বজনীন বোধে পরিণত হওয়ার কারণেই বুর্জোয়া সমাজ ঐতিহাসিক ভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের একটি সমাজ। তাহলে 'সমাজ' নিজেও কোন সর্বজনীন ধারণা নয়। পুঁজিতান্ত্রিক বাজারি সমাজের মধ্যেও আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে নানান 'সমাজ' বা 'গোষ্ঠি'র গঠন আমরা দেখি। নিজেকে যে কেউই 'মুসলমান', 'ইসলামপন্থি', 'নাস্তিক', 'বাঙালি' , 'জুম্ম', 'পাহাড়ি', 'হিন্দু' ইত্যাদি পরিচয় দিতে পারে বটে, কিন্তু শেষাবধি পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে পরিচয় ভিত্তিক সমাজ বা গোষ্ঠি নিজেদের গোষ্ঠিস্বার্থ রক্ষার অধিক 'সামাজিক' হতে পারে না।  আত্মপরিচয়ের রাজনীতি এবং নিজের স্বার্থের বিপরীত শ্রেণি বা গোষ্ঠিকে 'অপর' গণ্য করা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণি ও গোষ্ঠির আর্থ-সামাজিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব মাত্র। বাজারি ব্যবস্থার ভিত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ ছাড়া বাজারি ব্যবস্থার মধ্যে থেকে এই দ্বন্দ্বের কোন সমাধান নাই। দিন শেষে সকলেই মূলত ব্যক্তি স্বার্থে অন্ধ জীব মাত্র, নিছকই বাজারি ব্যবস্থার মধ্যে উৎপাদিত 'বুর্জোয়া'।

এই সমাজ উদ্ভবের প্রস্তুতিও চলেছে বহু আগে থেকে। মানুষকে একা, বিচ্ছিন্ন 'ব্যক্তি হিশাবে ভাববার শুরু সেই ষোল শ শতক থেকে; মাত্র আঠারো শতকে এসে পাশ্চাত্য সমাজ বাজারি (civil society) সমাজ হিশাবে পরিণত রূপ নেয়। মানুষের মধ্যেও বুর্জোয়া বা ব্যক্তিতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা ধীরে ধীরে বদ্ধমূল ও সর্বজনীন বোধ হয়ে ওঠে। (Marx, 1973, পৃষ্ঠা ৮৩)

প্রশ্ন হতে পারে নিজেকে এবং অপরকে একা, বিচ্ছিন্ন, সমাজ থেকে আলাদা ভাবা সত্য নাকি মিথ্যা? কার্ল মার্কস কিন্তু সেই প্রশ্ন তোলেন না, সেই তর্ক করেনও না। সত্য/মিথ্যা বিচার মার্কসের পদ্ধতি না। মার্কসের পদ্ধতি হচ্ছে যে অনুমান বা যুক্তির ভিত্তিতে মানুষ সত্য মিথ্যা নির্ণয় করে সেই সকল অনুমান, যুক্তি, যুক্তির প্রক্রিয়া, সিদ্ধান্ত নেবার পদ্ধতি ইত্যাদি পর্যালোচনা করা। সর্বোপরি যে বাস্তব ইহলৌকিক অবস্থার মধ্যে থেকে সত্য/মিথ্যার তর্ক চলছে রক্তমাংসের মানুষের সেই দুনিয়াবি অবস্থার সঙ্গে তার চিন্তা-চেতনার সম্বন্ধ বিচার করে দেখা।

বাজারি সমাজের চরম প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে সমাজ-বিচ্ছিন্ন একা, নিঃসঙ্গ বা চরম ব্যক্তিবোধ মানুষের ঐতিহাসিক একটি অবস্থা। চিরায়ত কিছু না, সাময়িক। এটা কোন অস্বাভাবিক অবস্থা না, মানসিক ব্যাধিও নয়। কিন্তু আবার স্বাভাবিক ব্যাপারও নয়। কেন এটা স্বাভাবিক নয়, আবার অস্বাভাবিকও নয়? কারন এই অবস্থাটা ঐতিহাসিক। দলবদ্ধ বা সামাজিক ভাবে মানুষ কিভাবে বাঁচে, জীবন যাপন করে বা বর্তমান থাকে এবং কিভাবে মানুষের বর্তমান অবস্থার ঐতিহাসিক উদ্ভব ঘটল তার বিচার ছাড়া মানুষ কেন একা, নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্নতাবোধে ভোগে সেটা বোঝা যাবে না। অর্থাৎ ইতিহাসে অজ্ঞ থাকলে, কিম্বা মানুষ ও মানুষের সমাজকে ঐতিহাসিক ভাবে বিচার করতে না জানলে স্বাভাবিক/অস্বাভাবিকের তর্কে আমাদের খামাখা খাবি খেতে হবে। মানুষের বুর্জোয়া হাল বোঝা যাবে না, বিশ্লেষণ তো দূরের কথা। তাহলে তথাকথিত স্বাধীন সার্বভৌম ব্যক্তির রহস্য বা অবস্থাকে বুঝতে হলে মানুষের ঐতিহাসিক অবস্থাকে স্বাভাবিক/অস্বভাবিক, জৈবিক/মানবিক, প্রাকৃতিক/সামাজিক ইত্যাদি নানান প্রকার বাইনারি মার্কা তর্কের বাইরে ঐতিহাসিক বিচার-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই বুঝতে হবে।

ইতিহাস, ঐতিহাসিকতা, ইতিহাস বিজ্ঞান, ইতিহাস সচেতনতা ইত্যাদি এই কারণেই মার্কসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ইতিহাস চেতনা থাকলে এটাও সহজে বোঝা যায় মানুষের এই বুর্জোয়া অবস্থা সাময়িক। মানুষ তার এই হাল বা অবস্থা অচিরে ঐতিহাসিক ভাবেই অতিক্রম করে যাবে। মানুষের সেই সক্ষমতা আছে।

মানুষের সক্ষমতা আছে সেটা আমরা কিভাবে বুঝি? এ কারণেই বুঝি যে স্বার্থপর আত্মসর্বস্ব ব্যক্তি হওয়া মানুষের চিরায়ত ধর্ম বা স্বভাব নয়। 'এক' সব সময়ই 'অনেক'-এর মধ্যে লীন হতে চায়, আর 'অনেক' একের মধ্য দিয়েই সমাজ মূর্ত বা বর্তমান থাকে। অতএব মানুষ মাত্রই সামাজিক, সমাজবদ্ধ জীব অতি সরল শোনালেও ধর্ম বলি কি ইতিহাস বলি এর অনুরণণ ও আওয়াজ ইতিহাসের সর্বকালেই ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে।

মানুষ সামাজিক, সমাজেই তার মুক্তি, আনন্দ ও স্ফুর্তি। ফলে আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক বাজারি সমাজ মানুষ একদিন না একদিন অতিক্রম করে যাবেই। বাজারি সমাজ অতিক্রম করে যাবার জন্য যে কর্তাশক্তিটুকু মানুষের দরকার তা হচ্ছে মার্কসের ভাষায় ইতিহাস-চেতনা, বাংলাদেশের সাধারন মানুষের ভাষায় রুহানিয়াত। এই  ইতিহাস চেতনা মানুষকে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থা অতিক্রম করে যেতে সক্ষম করে তোলে এবং সমাজে সেই সংকল্প ও বিশ্বাস জারি রাখে যে এখন যা প্রত্যক্ষ করছি সেটাই মানুষের শেষ অবস্থা নয়, চরম নিয়তি নয়। এরপরও ভবিষ্যৎ আছে, আরেক জগত আছে, আরও ইতিহাস আছে। মানুষের পক্ষে ভিন্ন জগৎ নির্মাণ সম্ভব। বুর্জোয়া ব্যক্তিতন্ত্রের চরম স্বার্থার্ন্ধ সমাজে নিত্যদিন খাবি খেতে খেতে এই বিশ্বাস জারি রাখা কঠিন যে মানুষ স্বার্থপর ব্যক্তি মাত্র নয়, মানুষ 'সামাজিক'। কিন্তু তারপরও ঘোষণা জারি থাকে। এই ঘোষণা জারি রাখা বিপ্লবী রণধ্বণিও বটে। এই রণধ্বণির মধ্যে বর্তমান অবস্থা অতিক্রম করে যাবার প্রতিশ্রুতি নিহিত।

বলা বাহুল্য, বর্তমান বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাই মানুষের শেষ গন্তব্য নয়, মানুষের সম্ভাবনা আরো বিপুল ও ব্যাপক, এই উপলব্ধিকেই এখানে রুহানিয়াত বলছি, কারন বাজারি ব্যবস্থায় নিত্যদিনের ব্যক্তিস্বার্থের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জর্জরিত মানুষ সামাজিক বা সামষ্টিক আকাঙ্ক্ষা, কিম্বা বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন হবে এই আশা নিয়েই বাঁচে। যে ভাষা বা পরিভাষা দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে বিশ্ব ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এখনকার রাজনৈতিক কর্তব্য সহজে বোঝানো যায় সেই ভাষা রপ্ত করা কর্তব্যও বটে। রুহানিয়াত নিছকই বাজারি সমাজে ব্যক্তি স্বার্থ নির্ণয় বা নাফসানিয়াতের মামলা নয়, বরং বৃহত্তর সমাজ ও সমষ্টি নিয়ে ভাবনার দরজা। পুঁজিতান্ত্রিক বাজারি ব্যবস্থায় দুনিয়াবি দুর্দশার মধ্যে যে মানুষ নিপতিত ও অধঃপতিত হয়েছে সেই অবস্থা মানুষের একমাত্র নিয়তি নয়, এই বিশ্বাস জারি রাখাই রুহানিয়াতের কাজ।

রুহানিয়াত সম্পন্ন মানুষ তাই বারবারই বিদ্রোহ করে এবং প্রতিটি বিপ্লব বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত মানুষের যৌথ ঘটনা হিশাবে বারংবার মানুষের সামাজিকতারই জয়গান ঘোষণা করে। বিপ্লব সব সময়ই একট সামাজিক ও যৌথ প্রকল্প। রুহানিয়াতের চর্চা ও বিকাশের জন্যই দরকার ঐতিহাসিক প্রজ্ঞা, ইতিহাস-চেতনা। অর্থাৎ এই বোধ যে মানুষ মাত্রই সামাজিক, সমাজবদ্ধ জীব, সমাজেই তার আনন্দ। মানুষের ইতিহাস মানে সমাজবদ্ধ জীব হিশাবে টিকে থাকবার এবং সামাজিক বোধ বিকাশের ইতিহাস; সবাইকে নিয়ে সকলের মধ্যে বাস করবার বৈশ্বিক সামাজিক বোধ বা বিশ্ব সমাজের আবির্ভাব ঘটানোর ইতিহাস, মার্কস এই বোশ্বিক সামাজিকতাকেই 'কমিউনিজম' নামে বুঝেছেন। মার্কস যদি ইউরোপীয় না হয়ে আরব বা বাঙালি হতেন তাহলে হয়তো কমিউনিজমের একটা আরবি কিম্বা বাংলা নাম দিতেন। এই হোল পার্থক্য। জর্মান কার্ল মার্কসকে আমাদের নিজেদের বোঝাবুঝির জায়গা থেকেই পাঠ করতে হবে। বাইরের কারো নোটবই পড়ে কার্ল মার্কস বোঝা যাবে না।

ওপরের আলোচনায় এই ইঙ্গিত রয়েছে যে পিঁপড়ার দলবদ্ধতাকে 'সমাজ' বলাও মানুষের চেতনার একটি বিশেষ ঐতিহাসিক পর্যায়। 'সমাজ' কথাটার তাৎপর্য তাহলে নানান দিক থেকে বোঝার দরকার রয়েছে। পিঁপড়ার সমাজের সঙ্গে মানুষের সমাজের ভেদবিচারের মধ্য দিয়ে আমরা 'সমাজ' সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা এই বইয়ে তৈরির চেষ্টা করেছি। মানুষের সমাজ আর প্রাকৃতিক সমাজ কিম্বা মানুষ আর প্রকৃতির ফারাক বা ভেদবিন্দুটা তাহলে কোথায়? মার্কসের দাবি মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভর না থেকে যখন উৎপাদন করতে শিখলো, তখন মানুষ আর নিছকই প্রকৃতি থাকলো না। প্রকৃতিও মানবিক বা মানুষের ইতিহাসে রূপান্তরিত হতে শুরু করল। এই বিষয়গুলো বিস্তৃত ভাবে আমরা অন্যত্র আলোচনা করব। অন্যদিকে পুঁজিতান্ত্রিক উৎপাদন আলাদা আলাদা ব্যাক্তিগত মালিকানার ভিত্তিতে হলেও মার্কসের কাছে তা ‘সামাজিক ভাবে নির্ণিত ব্যক্তিগত উৎপাদন’ (Marx, 1973, পৃ. 83)। পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সমাজ আছে বলেই মানুষ প্রাকৃতিক ভাবে টিকে থাকে। প্রকৃতির ইতিহাসও মানুষের কর্ম তৎপরতা ইতিহাস হয়ে উঠেছে। উৎপাদনের সম্পর্ক ও সহযোগিতাই প্রকৃতি বা জীব হিশাবে সামাজিক মানুষের টিকে থাকার শর্ত। মানুষ সদা সর্বদাই সামাজিক। যখন প্রকৃতির ওপর নির্ভর না করে মানুষ নিজের উৎপাদন নিজে করতে শিখল, তখন প্রকৃতি থেকে আলাদা মানুষের সমাজ ও ইতিহাসেরও শুরু।

আধুনিক কালপর্বে এসে ‘সমাজ’ কথাটি ‘প্রকৃতি’ থেকে ভিন্ন অর্থে ব্যবহার শুরু হয়। এমনকি প্রকৃতির বিপরীতেই ‘সমাজ’ নামক ধারণা আস্তে আস্তে বদ্ধমূল হতে শুরু করে। এই বিভাজন থেকে আরেকটি চিন্তা বদ্ধমূল হয় যে মনুষ্য সমাজের চাহিদা ও দাবি আগে তারপর প্রকৃতি নিয়ে ভাবা। প্রকৃতির ওপর মানুষের আধিপত্য বা প্রকৃতিকে জয় করা 'প্রগতি' বলে চিহ্নিত করা শুরু হোল। এর ফলে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি হতে শুরু করলো। এই ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, 'সমাজ' ও প্রকৃতির সঠিক ভেদবিচারের মধ্যে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সঠিক অভিমুখ নির্ণয়ের প্রশ্ন জড়িত। আশা করি বোঝাতে পারছি মানুষ আর পিঁপড়ার ফারাক নির্ণয় যতো সরল বিষয় মনে হয় বিষয়টি ততো সরল মোটেও নয়।

মানুষ ও পিঁপড়াকে একসঙ্গে দেখেই তাদের দলবদ্ধতাকে 'সমাজ' বললে আমরা চিন্তার সেই পর্যায়ে থাকি যখন উভয়ের সামাজিক সত্তা একই সঙ্গে তাদের প্রাকৃতিক বা জৈবিক সত্তা। অর্থাৎ বলা হচ্ছে, প্রাকৃতিক সত্তা ও সামাজিক সত্তা অভিন্ন। আধুনিক কালে এই অনুমান বদলে যেতে শুরু করেছে। প্রাকৃতিক ও সামাজিক সত্তার মিল ও অমিল নতুন জিজ্ঞাসার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ‘এক’ এবং ‘অনেক’-এর সম্বন্ধ বিচার এই ক্ষেত্রে আর এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। জরুরী হয়ে পড়েছে। এই সম্বন্ধ বিচার করেই নির্ণয় করত হচ্ছে ‘সমাজ’ কখন প্রকৃতি, আর কখন প্রকৃতি থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে 'সমাজ' হয়? প্রশ্ন জাগে ‘আধুনিক সমাজ জীবন’ কথাটার মানে কি? এ্টা কি প্রাকৃতিক বা জৈবিক কোন বৈশিষ্ট্য, নাকি এমন একটা নতুন ঘটনা যা আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

মার্কসের দাবি হচ্ছে এক ও অনেকের মধ্যে এই সম্বন্ধকে সামাজিক উৎপাদন সম্পর্ক দিয়েই বুঝতে হবে। আধুনিক কালে ‘সমাজ’কে আমরা আর স্রেফ দলবদ্ধ জীবের জীবন অর্থে ব্যবহার করছি না। কিন্তু জীবের জীবন টিকিয়ে রাখার সম্বন্ধ তো আসলে প্রাকৃতিক সম্বন্ধ। মার্কসের ভাষায় যা 'উৎপাদন সম্পর্ক হিশাবে পরিচিত। মানুষ সামাজিক বটে, কিন্তু সেটা তার জৈবিকতা বা প্রাকৃতিকতা বাদ দিয়ে নয়। শেষাবধি মানুষের জৈবিক প্রকৃতি এমনই যে নিজের জীবন আর প্রজাতির জীবন উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন নিশ্চিত করা ছাড়া মানুষ টিকে থাকতে পারে না।

পিঁপড়াকেও তার নিজের জীবন আর প্রজাতি উৎপাদন নিশ্চিত করতে হয়। মার্কস যে অর্থে সমাজ বলতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধকে উৎপাদন সম্পর্ক দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন তেমনি পিঁপড়ার সঙ্গে পিঁপড়ার সম্পর্কের মধ্যেও উৎপাদন সম্পর্ক কাজ করে। সে সম্পর্ক সামাজিক নাকি প্রাকৃতিক সেটাই বরং নতুন একটি জিজ্ঞাসা হয়ে উঠল। কিন্তু দলবদ্ধতা, সহযোগিতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের বাইরে সমাজ কথাটার যদি আর কোন অতিরিক্ত অর্থ না থাকে তাহলে পিঁপড়া 'সামাজিক' এই ধারণা অস্বীকার করবার বিশেষ কোন যুক্তি রইল না। কিন্তু মানুষ 'সামাজিক' এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ রুহানি গুণ সম্পন্ন জীব এই তর্ক সামনে চলে আসে।

দার্শনিক বা ভাবুকরা সাধারণত নাছোড়বান্দা হয়। আধুনিক কালে ইতোমধ্যে আরেকটি ধারণা দানা বাঁধে। সেটা হচ্ছে ‘ইতিহাস’। তাই প্রশ্ন ওঠে, পিঁপড়ার সমাজ আর মানুষের সমাজ যদি একই জৈবিক বা বৈষয়িক অর্থে প্রাকৃতিক হয় তাহলে তো বলতে হয় পিঁপড়ারও ইতিহাস আছে। মার্কসবাদীরা চার্লস ডারউইনকে সাক্ষী এনে বলেন, আছেই তো। পিঁপড়ার ইতিহাস মানে প্রাকৃতিক বিবর্তন। পিঁপড়ার বিবর্তন আছে।

কিন্তু এতে তর্ক মেটে না। কারণ প্রাকৃতিক বিবর্তন আর মানুষের ইতিহাস কি একই কথা? দুয়ের মধ্যে কি কোন পার্থক্য নাই? ধীরে ধীরে তর্ক আরও প্রসারিত ও গভীর হয়। আধুনিক দর্শনে একে বলা হয় এতোদিনের জানা বিষয়কে প্রব্লেমেটিক বা অনিশ্চিত করে তোলা। যে-জ্ঞানকে ‘নিশ্চিত’ বলে এতোকাল জেনে এসেছি সেই আরামকে হারাম করা, ‘অনিশ্চিত’ করে তোলা। ‘প্রবলেমেটাইজ’ (problematise) করা দর্শনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ চর্চা। যা এতোকাল সরল আর নির্দোষ মনে হয়েছিল তা যে আসলে জটিল বিষয় তাকে সামনে আনা, দৃশ্যমান করে তোলা দার্শনিক বিচারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এই উপলব্ধি সমাজে নতুন চিন্তার আবির্ভাবের ইঙ্গিত দেয়। চিন্তার একটা স্তরে যা একদা বিশদ ছিল, যাকে একদা সহজ মনে হয়েছিল তা এখন আর সরল সিধা ব্যাপার না। নিশ্চিত বিষয় যখন প্রশ্ন বোধক হয়ে ওঠে তখন তা নতুন চিন্তা বা ভাবুকতার উপসর্গ হয়ে ওঠে। বোঝা যায়, চিন্তা নতুন কিছু বিষয় নিয়ে ভাববার জন্য প্রস্তুত হয়েছে। কিম্বা চিন্তা হয়তো গোড়ায় কিছু ভুল করেছে, কিছু বিষয় ভাবতে ভুলে গিয়েছে, অতএব সেই ভুলে যাওয়া বিষয় নতুন করে ভাববার জন্য নতুন প্রশ্ন হাজির করছে, নতুন ভাবে জিজ্ঞাসা তৈরি করছে; এতোদিন যে সকল বিষয় জিজ্ঞাসার বাইরে ছিল, তাদের জিজ্ঞাসার অধীনে আনার ‘সময়’ হয়েছে। এই ভাবে চিন্তার দিক থেকে নতুন কালপর্বের শুরু হয়।

কথাগুলো এতো তাড়াতাড়ি হয়তো বুঝব না। এতোটুকু আপাতত বুঝলেই যথেষ্ট যে এখন, আধুনিকতার এই বিশেষ কালে, যে ভাবে আমরা বর্তমান আছি বা থাকি, কিম্বা যে প্রকার সময়ের মধ্যে আমাদের বসবাস–সেই অবস্থায় মানুষ আর পিঁপড়ার ভেদবিচার নিজেদের অবস্থা বোঝার জন্যই আমাদের দরকার। চিন্তাকে সাহসের সঙ্গে নতুন জিজ্ঞাসা মোকাবিলা করতে হয়। নিজের উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত পেশ করবার জন্য নতুন ভাষা ও পরিভাষা আবিষ্কার করতে হয়। মানুষ আর পিঁপড়ার ভেদবিচারের ক্ষেত্রেও অন্যথা হবার জো নাই। সেটা কেন দরকার সেটা ব্যাখ্যা করাও এই বইটির উদ্দেশ্য। মানুষ আর পিঁপড়ার পার্থক্য সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা মোকাবিলা কেন প্রয়োজন এই লেখা যারা অনুসরণ করবেন তারা আশা করি নিজেরাই তা উপলব্ধি করবেন। তবে শিশুতোষ আর সরল জিজ্ঞাসা হলেও মানুষ আর পিঁপড়ার পার্থক্য বিচার যে যথেষ্ট জটিল বিষয়, সেটা আশা করি বোঝাতে পেরেছি।

সর্বজনীনতা বনাম বিশেষীকরণ

দর্শন বা ভাবচর্চায় সময় মানে অন্য প্রকার ‘সময়’। সেই ‘সময়’ ঘড়ির কাঁটা মেনে হিসাব করা যায় না। দেখা যায় চিন্তা একটা ধাপে এসে আটকা পড়ে যাচ্ছে, জট খুলতে তার লম্বা সময় লেগে যাচ্ছে। অন্যদিকে অনেক ‘সময়’ অনেক জটিল ও কঠিন ধাপ চিন্তা সহজেই অতিক্রম করে যায়। এখানে আমাদের উদ্দেশ্য আসলে ‘আধুনিকতা’ নামে যাকে আমরা নির্বিচারে মেনে নেই তাকে পর্যালোচনার একটা ক্ষেত্র তৈরি করা।

কিন্তু আধুনিকতার সময়কালটা আমরা মাপব কিভাবে? এই আধুনিকতার উৎপত্তি পাশ্চাত্য – বিশেষ ভাবে গ্রিক-রোমান-খ্রিস্টিয় চিন্তার পরিমণ্ডলে। তাহলে কি গ্রিক দার্শনিকরা শুরুতে যেভাবে ভবেছেন সেই সময়ের অনুমান ও সিদ্ধান্ত পাশ্চাত্য আধুনিকতা ধারণ করেই ‘আধুনিক’ হয়েছে? নাকি আধুনিকতার উৎপত্তি তার গ্রিক অনুমান ও ধারনা থেকে বিচ্যুতি। যেভাবেই ভাবি, আধুনিকতার আলোচনায় বারবার ফিরে যেতে হচ্ছে গ্রিসে, তাদের নগর রাষ্ট্রে। যেতে হচ্ছে এথেন্সে? পাশ্চাত্যের বাঘা বাঘা দার্শনিকদের লেখা পড়ে মনে হয় আসলেই, আধুনিক পাশ্চাত্যের ভিত্তি খুঁজতে হলে গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তা অবধি দৌড়াতে হয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে পাশ্চাত্যের চিন্তা বা দর্শন নিজেই তার অনুমান, বিশ্বাস ও জ্ঞানকাণ্ড নিজের চিন্তার ইতিহাসের ভেতর থেকেই পর্যালোচনা করছে। সমাজ, জীবের জীবন, রাজনৈতিক জীবন, সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র, ইত্যাদি নিয়ে পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা কিভাবে ভাবছেন মানুষ ও পিঁপড়ার সমাজের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের সূত্র ধরে তার প্রাথমিক হদিস নেওয়াই এখানে আমাদের উদ্দেশ্য।

দূরবর্তী ইচ্ছাও আছে আমাদের। এই পর্যায়ে তাকে উচ্চাভিলাষী মনে হতে পারে, কিন্তু বলা রাখার মধ্যে কোন দোষ দেখি না। এটা আমরা জানি, পাশ্চাত্য চিন্তার পদ্ধতি এবং সেই পদ্ধতির ফলাফলই চিন্তার সর্বজনীন রূপ এবং আদর্শ বলেই গণ্য করা হয়। বিশেষত বাংলাদেশের মতো প্রান্তিক দেশে। এর ফলে পৃথিবী ব্যাপী পাশ্চাত্য চিন্তার ঘোর আধিপত্য তৈরি হয়েছে। বলাবাহুল্য এই আধিপত্যের সঙ্গে ঔপনিবেশিকতা, সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্প্রতিক অসম গোলকায়নের প্রসঙ্গ জড়িত। এই আধিপত্যের উপলব্ধি এবং সেই আধিপত্য থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনা মূলত রাজনৈতিক, কিন্তু এই রাজনৈতিক কর্তব্য প্রাচ্য/পাশ্চাত্যের দৃশ্যমান ভেদ মেনে চিন্তা পালন করতে পারে কিনা সন্দেহ। অর্থাৎ কোন চিন্তা, ভাব বা দর্শনের উৎপত্তি পাশ্চাত্যের বলে তার কাছ থেকে চিন্তা দূরে সরে থাকতে পারে না। চিন্তার বিকাশের জন্য তা আত্মঘাতী হতে বাধ্য। পাশ্চাত্য কে প্রতিরোধ কিম্বা অতিক্রম করে যেতে হলে তাকে আত্মস্থ করার বিকল্প নাই। আর প্রতিরোধের প্রশ্নে প্রাচ্যকে ফিরে আসতে হবে তার নিজের চিন্তার ভূগোলে। বাইরের সব দরজা জানালা বন্ধ করে নয়। বরং প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো তাকে খুঁজতে হবে পাশ্চাত্য তার আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রাচ্যের চিন্তাকে যেখানে দাবিয়ে রেখেছে, যে সকল বিষয় ভাবতে ভুলিয়ে দিয়েছে সেই সকল অনুমান, পদ্ধতি বা সিদ্ধান্ত খুঁড়ে বের করা। রাজনৈতিক প্রতিরোধের রসদ সমভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে অনুসন্ধান করা চিন্তার কর্তব্য। অতএব আমাদের দূরবর্তী ইচ্ছা নিজেদের ভূগোলে সেই প্রত্নতাত্ত্বিক কাজগুলো করবার ক্ষেত্র তৈরি করা।

পাশ্চাত্য চিন্তার পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার কথা আমরা প্রায়ই বলি। কিন্তু সজীব ও সক্রিয় চিন্তার চর্চার দিক থেকে এর ঠিক কী মানে, তা স্পষ্ট নয়। সেই ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য চিন্তার পরিমণ্ডলের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিন্ন ভাবে চিন্তার কোন সম্ভাবনা আছে কিনা তা বিচার করবার শর্ত ও সুযোগ তৈরি করা সবার আগে দরকার। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে কোদালী – অর্থাৎ সবচেয়ে পরিশ্রমের কাজ হচ্ছে নিজের ভাষায় দর্শন –অর্থাৎ ভাবচর্চার শক্তিশালী ধারা গড়ে তোলা। এখানে আমাদের পদে পদে হোঁচট খেতে হবে। কারণ দর্শন বা ভাবচর্চার উপযুক্ত ভাষা আমরা তৈরি করতে পারি নি। কিন্তু চর্চা ছাড়া এই অভাব কাটিয়ে ওঠার কোন বিকল্প নাই। তার জন্য আধুনিক পাশ্চাত্য তার নিজের ভেতর থেকে নিজের চিন্তার সংকট যেভাবে চিহ্নিত করছে তার সঙ্গে আমাদের সম্যক পরিচয় দরকার। দ্বিতীয়ত প্রাচ্য/পাশ্চাত্যের বাইনারি বানিয়ে, কাল্পনিক প্রাচ্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে পাশ্চাত্যের বিরোধিতা ফলপ্রসূ কিছু পয়দা করবে না। বরং প্রাচ্যের নিজস্ব জিজ্ঞাসাগুলোকে শনাক্ত করা এবং সে জিজ্ঞাসার তাৎপর্য 'গোলকায়নের কালে গোলকায়িত' করবার সামর্থ অর্জন এখন বড় কাজ। অর্থাৎ প্রাচ্যের জিজ্ঞাসা যে নিছকই প্রান্তিক কিম্বা স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং চিন্তার দিক থেকে গোলোকীয় বা বৈশ্বিক জিজ্ঞাসা, সেই ভাবে আমাদের জিজ্ঞাসাকে হাজির করতে পারার সামর্থ অর্জন এখন খুবই জরুরী।

আমাদের নিজদের বিকাশের নির্ধারক দিক হচ্ছে পাশ্চাত্য যেসব চিন্তার উপাদান, সূত্র, চিহ্ন, রূপ ও ধারাকে নৃশংস ভাবে মুছে দিয়েছে বা প্রান্তিক করে ফেলেছে সেই ধ্বংস্তুপের মধ্যে এমন কোন উপাদান, পদ্ধতি, ব্যাকরণ বা প্রকরণ খুঁজে পাওয়া যায় কিনা যা চিন্তার বর্তমান বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে কথোপকথনের শর্ত তোইরি করে এবং অসম গোলকায়নের বর্তমান পর্যায় অতিক্রম করে যেতে আমাদের সহায়ক হয়।

এই পরিপ্রেক্ষিতে দুটো অনুমান আমি মাথায় রাখি। এক. আধুনিকতার একটা সংকট চলছে। সেতা কী, সেতা না হয় আমরা উপযুক্ত জায়গায় আলোচনা করব। সুবিধা হচ্ছে পাশ্চাত্য দার্শনিকরাও এই সংকট উপলব্ধি ও অকপটে স্বীকার করেন। এই উপলব্ধির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা হচ্ছে এই যে অনেকে মনে করেন পাশ্চাত্য চিন্তার বর্তমান পরিমণ্ডলে সেই সংকট মোচন সম্ভব নয়। নতুন ভাবে ভাবতে পারার সামর্থ অর্জন দরকার। আমামদের প্রশ্ন হবে নতুন ভাবে ভাবতে পারার ক্ষেত্রে প্রাচ্য কি কোন ভূমিকা রাখতে পারবে?

এর উত্তর আলোচনার এই অতি প্রাথমিক পর্যায়ে একান্তই রাজনৈতিক সংকল্প হিসাবে বলে রাখা যায়, তবে হাতে নাতে কাজ করে না দেখালে তা হাওয়াই আওয়াজের অধিক কিছু নয়। কিন্তু এই সংকল্পটুকু আমাদের প্রাণ। আমরা অন্বেষণের পক্ষপাতি। পাশ্চাত্য আধুনিকতা নিজের সংকট নিজে মীমাংসা করতে সক্ষম নয়, এই সন্দেহ পোষণ করা এবং সেই সন্দেহ জারি রেখে পাশ্চাত্যের প্রান্তে -- অসম বিশ্বব্যবস্থার আধিপত্যের আড়ালে পড়ে থাকা চিন্তা বা ভাব চর্চার ধারা অন্বেষণ আমামদের একটি জরুরী কাজ। পাশ্চাত্যের পাশাপাশি প্রাচ্যও চিন্তার গোড়ার বিষয় নিয়ে নতুন ভাবে ভাবুক, ভাবতে পারার সাহস অর্জন করুক – সেই শর্ত তৈয়ারি আমাদের এখনকার কাজ। কিন্তু সেটা করতে হবে আমাদের নিজেদের ভাষায়। একান্তই নিজেদের জমিনে। হয়তো নিজেদেরই ভুলে যাওয়া শব্দ, ধারণা বা ভাবুকতার চিহ্ন আবিষ্কার করে।

কথাটা যতো সহজে বলছি কাজটা তুলনায় হাজারগুণ কঠিন। পাশ্চাত্য চিন্তা আসমান থেকে পড়ে নি। তার বিশেষ ইতিহাস আছে। সেই ‘বিশেষ’ ইতিহাস ‘সর্বজনীন’ ইতিহাস হিসাবে শুরুতে হুকুম জারি করে মানানো হয়েছিল। এই হুকুমের কালপর্বকে আমরা বলি, ঔপনিবেশিক শাসন। কিন্তু এখন মানি স্বেচ্ছায়। বৃটিশ চলে যাবার পর পুরানা হুকুম ঔপনিবেশিক শক্তির ক্ষমতা হয়ে জারি নাই; পাশ্চাত্যের ইতিহাসকে সর্বজনীন ইতিহাস হিসাবে আমাদের হুকুম দিয়ে মানতে কেউ আমামদের বাধ্য করে না। অথচ বিলাতের রানি এখন আমাদের হৃদয়ের সিংহাসনেই মুকুট ও দণ্ডসহ বলবৎ আছেন। আমরা ‘আধুনিক শিক্ষা’ ও ‘আধুনিকতা’ নামে স্বেচ্ছায় যা চর্চা করি সেটা আগের হুকুমই নির্বিচার পালন। সেই হুকুমের মর্ম হচ্ছে এই যে পাশ্চাত্যের ইতিহাস যে মানদণ্ডে নিজেকে সভ্য বলে সেটাই ‘সভ্যতা’ এবং পাশ্চাত্য চিন্তাই মানবেতিহাসের ‘সর্বজনীন’ চিন্তার রূপ। আমাদের সভ্য ও চিন্তাশীল হবার একটাই পথ, পাশ্চাত্যের অনুকরণ এবং পাশ্চাত্য চিন্তাকেই চিন্তার ‘সর্বজনীন’ রূপ গণ্য করা। পাশ্চাত্য চিন্তাকে ‘সর্বজনীন’ গণ্য করতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই যে চিন্তা ময়রার হাতে বানানো রসগোল্লা নয় যে গোলগাল তৈরি হয়ে স্রেফ ভোগের জন্য হাজির থাকে। যে কোন চিন্তার ইতিহাসই নানান দ্বন্দ্ব, স্ববিরোধি্তা, তর্কবিতর্ক ও বিভিন্ন প্রশ্নের মীমাংসার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে। কিন্তু পাশ্চাত্যের সেই ইতিহাসে আমরা অংশ নেইনি। অতএব অর্জনেও আমাদের অংশ নাই, তেমনি কোন ভূমিকাও নাই। পাশ্চাত্যের জিজ্ঞাসার ইতিহাস সম্পর্কেও আমামদের বিশেষ ধারণা নাই। চিন্তার দিক থেকে পাশ্চাত্য চিন্তাকে ‘সর্বজনীন’ গণ্য করতে গিয়ে আমরা ডবল কাফ্‌ফারা গুনছি। একদিকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর আমরা পাশ্চাত্যের কাছ টুকছি, কিন্তু দার্শনিক বিচার ও জজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য চিন্তার প্রাকরণিক বা পদ্ধতিগত দিকের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের কোন জ্ঞান নাই। আমরা পাশ্চাত্য চিন্তার কারখানা থেকে পণ্যটুকু পাই ও ভোগ করি, কিন্তু তাদের কারখানা কভাবে তৈরি, উৎপাদন প্রক্রিয়া কেমন ইত্যাদি ব্যাকরণ, প্রকরণ বা কারিগরি দিক সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নাই বললে চলে।

তুলনা দিলে সেটা ভাল বোঝা যাবে। পাশ্চাত্য থেকে ‘কোকাকোলা’ আমদানি করে আমরা খাচ্ছি, কিন্ত কিভাবে ‘কোক’ বানানো হোল, কিম্বা কেনই বা বানানো হোল আমরা তা জানি না। আমরা স্রেফ ভোক্তা – উৎপাদক না; ভোগের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও আমাদের কোন জ্ঞান নাই। ‘কোক’ আদৌ পানীয় কিম্বা আমাদের তৃষ্ণা মেটায় কিনা সেই প্রশ্ন তোলার তৌফিকও আমরা পোস্ট-কলোনিয়াল অবস্থায় আজও অর্জন করতে পারি নি। এটা একটা সিক্রেট ফর্মুলা আকারে রয়ে গিয়েছে। 

ডবল কাফ্‌ফারা – অর্থাৎ ১. যা খাচ্ছি তা কেন খাচ্ছি যেমন জানি না এবং ২. তেমনি, যা খাচ্ছি তা কিভাবে তৈরি হোল তার পদ্ধতি বা প্রকরণ সম্পর্কেও আমরা অজ্ঞ। সেই কারনেই বলছি, এই উত্তর-উপনিবেশিক বা পোস্ট-কলোনিয়াল হালে নিজেদের ভাষায় একান্তই নিজেদের জমিনে, নিজেদেরই ভুলে যাওয়া শব্দ, ধারণা বা ভাবুকতার চিহ্ন আবিষ্কার অতিশয় কঠিন একটি কাজ।

এখানেই শেষ নয়। বরং পরিস্থিতি যা বলেছি তার চেয়ে হাজার গুন কঠিন। কোন বিশেষ ধরণের চিন্তাকে ‘সর্বজনীন’ করার অর্থ একই প্রক্রিয়ায় চিন্তার অন্য ধরণ, প্রকরণ ও পদ্ধতির ‘বিশেষীকরণ’। সেটা কিভাবে ঘটে? যেমন, ইউরোপীয় চিন্তা বা দর্শনই হোল সর্বজনীন চিন্তা বা দর্শন, বাংলাদেশের চিন্তা বা ভাবুকতা এই প্রক্রিয়ায় হয়ে ওঠে ঐতিহ্য বা লোকায়ত সংস্কৃতি। বাংলাভাষায় দর্শনচর্চার ইতিহাস হয়ে যায় ‘পুঁথি’ সংগ্রহ, লোকায়ত সংস্কৃতি, আউল-বাউল-ফকির ফ্যাকড়াদের কাণ্ড। আর ‘পুঁথি’ – এমনকি যদি তা সৈয়দ সুলতানের ‘জ্ঞান চৌতিশা’ও হয় সেটা আবেগ, কল্পনা, সিনক্রেটিজম ইত্যাদির মাখামাখি। জগাখিচুড়ি। দাবি করা হয়, লালনের গান স্রেফ বাউলদের গান। আধা-পাগলা বা মাস্তান ফকিরদের সংস্কৃতি। দর্শন বা ভাবচর্চা নয়। আর তাদের আচার আচরনও গোপন ও গুহ্য। ওর মধ্যে দার্শনিকতা যদি কিছু থাকে তা আধুনিক চিন্তার কোন কাজে লাগে না। একালের কোন গুরুতর জিজ্ঞাসা সেখানে নাই। বিশেষীকরণের (particulatization) এই প্রক্রিয়া পাশ্চাত্যকে সার্বজনীন করবারই (universalization) পালটা দিক। একই প্রক্রিয়ার দুটো দিক মাত্র। সর্বজনীন জ্ঞান বা দর্শন মাত্রই ইউরোপীয় – তার আবাস গ্রিক-রোমান- খ্রিস্টিয় পরিমণ্ডলে। যা কিছুই অ-ইউরোপীয় – গ্রিক-রোমান-খ্রিস্টিয় পরিমণ্ডলের বাইরে তা নিছকই স্থানীয় ঐতিহ্য বা লোকায়ত সংস্কৃতি।

স্থানিক জিজ্ঞাসা ও গোলকায়িত বিশ্ব

আপাত দৃষ্টিতে খুবই নির্দোষ ও সরল একটি প্রশ্ন দিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করেছি। পিঁপড়া আর মানুষে পার্থক্য বা মিল কোথায়? নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন আমাদের প্রাচীন সমাজেও ছিল; হয়তো তার উত্তর কোথাও না কোথাও চাপা পড়ে আছে। অথচ এখানে আমরা দেখব গ্রিসে এই প্রশ্নের প্রাচীন মীমাংসাই আধুনিক পাশ্চাত্যের নিয়তি নির্ধারণ করে দিয়েছে। এই দিকটি যদি বুঝতে পারি, তাহলে আমার আশা, নিজেদের চিন্তার মধ্যে সহজ সরল গোড়ার প্রশ্ন গুলোর প্রতি নিষ্ঠ থাকার গুরুত্ব বুঝব। এবং নিজ নিজ ভাব চর্চার অপরিসীম গুরুত্ব ধরতে পারব। দূরবর্তী এই আশাটুকু শুরুতেই জারি রাখতে চাই।

আমরা আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাকে যথাসাধ্য স্পষ্ট ও প্রণালী বদ্ধ করবার জন্য কার্ল মার্কস থেকে শুরু করব। এই আরম্ভসুত্র একান্তই ব্যক্তিগত। কারণ পাশ্চাত্যের সঙ্গে আমার নিজের চিন্তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মোলাকাত কার্ল মার্কসের মধ্য দিয়ে। এই লেখার মধ্য দিয়ে নিজেকে বোঝা এবং আমার নিজের চিন্তার স্বরূপ ও সীমাবদ্ধতা শনাক্ত করাও আমার ইচ্ছা।

পাশ্চত্য চিন্তার মোকাবিলা করতে গিয়ে মার্কস-এঙ্গেলসের তরুণ বয়সের খসড়া লেখালিখি থেকে নতুন জিজ্ঞাসা তৈরি করতে পারাকে আমি অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। সম্প্রতি প্রকাশিত 'মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত' এই বইটির পরিপ্রেক্ষিত বোঝার সহায়ক।

মনে হতে পারে লেখাটিকে নাটকীয় করবার জন্য আমরা পিঁপড়ার প্রসঙ্গ এনেছি। মোটেও না। বরং জীবের সঙ্গে মানুষের পার্থক্য নির্ণয়ের ওপর একটি সমাজের ঐতিহাসিক অভিমুখ স্থির হয়ে যায় কিনা সেই গুরুতর প্রশ্নটি আমরা প্রণালীবদ্ধ ভাবে তুলতে চাই। মনুষ্যজীবনের নির্ধারক জিজ্ঞাসা বোম্বাস্টিক হয় না। আড়ম্বরহীন এবং সহজ সরলই হয়। পিঁপড়াও যদি সামাজিক হয় তাহলে মানুষের সঙ্গে পিঁপড়ার সমাজের পার্থক্য কি? মানুষ কেন পিঁপড়া নয়, কিম্বা পিঁপড়া কেন মানুষ নয়? নাকি উভয়েই এক। এই সহজ সরল জিজ্ঞাসাই এই বইয়ের উপজীব্য।

তদুপরি আমাদের ভাষা বাংলা, জর্মন, ফরাসি, ইটালিয়ান কিম্বা ইংরেজি নয়। এমনকি আরবি, ফারসি, হিন্দি, উর্দু বা সংস্কৃতও নয়। তাহলে আমরা যদি মৌলিক চিন্তা করতে চাই তাহলে আমাদের নিজের ভাষায় এমন ভাবে লিখতে শিখতে হবে যাতে তরুণ চিন্তাবিদদের আমরা চিন্তিত প্রণোদিত ও উৎসাহিত করতে পারি। নিজের চিন্তা নিজে কাছে স্পষ্ট কিনা তার পরীক্ষা অনেকাংশেই সহজে নিজের ভাষায় হাজির করতে পারার ওপর নির্ভর করে। এটাই আমি মনে করি। আমরাও নিজের ভাষায় চিন্তা করতে পারি, সেই সংকল্প দৃঢ় করা জরুরী। এমন ভাবে লিখবার চেষ্টা করছি যাতে আমাদের সমাজে আমরা অন্যান্য জীব থেকে মানুষকে কিভাবে পার্থক্য করি, কোথায় মিল উপলব্ধি করি, বা কোথায় কিভাবে জীবের সঙ্গে মানুষকে মেলাই সেই সকল অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ তর্কবিতর্ক সহজ ভাবে করার সুবিধা তৈরি হয়। জীব হিসাবে মানুষ আর মানুষ হিসাবে ‘মানুষ’ এই দুইয়ের মধ্যে কিভাবে আমাদের চিন্তা বা ভাবুকতা, আমাদের ঐতিহ্য কিম্বা সংস্কৃতি, অথবা নিত্যদিন অন্য জীব ও প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের আচার আচরণ আমাদের ভাষায় ব্যক্ত হয় সেই দিকে আমাদের নজর ও মনোযোগ ফেরানোই এই বইটির একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। জিজ্ঞাসা জাগুক যে কোথায় এবং কেন আমরা মানুষকে অন্যান্য জীবের সঙ্গে অভিন্ন ভাবি কিম্বা ফারাক নির্ণয় করি?

তবে এই বইতে বিশেষ ভাবে মানুষ ও পিঁপড়ার মিল ও পার্থকের সূত্র ধরেই আমরা সমাজ, সার্বভৌমত্ব, ক্ষমতা, রাষ্ট্র, শাসন ব্যবস্থা, নজরদারি এবং আধুনিক রাষ্ট্রে মানুষের জীবন কিভাবে পিঁপড়ার জীবনে পরিণত হয়েছে সেই সকল গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় প্রবেশ করবো। জীবের জীবন ও মানুষের জীবনের ভেদবিচার নিষ্পন্ন করতে গিয়ে আমরা পাশ্চাত্যের সামনের সারির কয়েকজন প্রধান দার্শনিকদের নিয়ে আলোচনা করব। তাঁরা হলেন এরস্টটল, হেগেল, কার্ল মার্কস, হানা আরেন্ট, কার্ল স্মিট, ওয়াল্টার বেঞ্জামিন, মিশেল ফুকো এবং  জোর্জিও আগামবেন। এছাড়া প্রসঙ্গ ক্রমেই হবস, লক, রুশো ও আরও অনেকে আসবেন।

পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা রূপান্তরের ক্ষেত্রে আমাদের স্থানীয় কর্তব্য নির্ণয়ের জন্য দুটো ক্ষেত্র দার্শনিক বিচারের জন্য জরুরী। একটি হচ্ছে ধর্মের পর্যালোচনা এবং বাংলাদেশে ইসলাম। এই ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে অনুমান হচ্ছে মানুষ, সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র ইত্যাদি প্রশ্নে ইসলামের কিছু মৌলিক প্রস্তাবনা রয়েছে যা পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের এই কালে সর্বজনীন জিজ্ঞাসা হিশাবে হাজির করা অতিশয় জরুরী। জিজ্ঞাসাগুলো গুছিয়ে হাজির করার অর্থ কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের ইমান-আকিদা বা ধর্মতত্ত্বের সত্যাসত্য বিচার নয়, সেটা আমাদের প্রাজ্ঞ আলেম-ওলেমাদের কাজ, দার্শনিকের নয়। বরং দার্শনিকের কাজ হচ্ছে সম্প্রদায় ও বিশ্বাস নির্বিশেষে ইসলামের জিজ্ঞাসাকে গোলকায়িত বিশ্বে সকল মানুষের জিজ্ঞাসায় পরিণত করা। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় ঐতিহ্য, ভাষা, সংস্কৃতি ও তর্কবিতর্ককে সমৃদ্ধ করা যাতে গণমানুষের চিত্তবৃত্তি ও বিচার ক্ষমতা বিকশিত হয়। বাংলাদেশের সমাজকে চিন্তায় ও সংস্কৃতিতে বৈশ্বিক করার দিয়েই স্থানীয় সংগ্রাম গোলকায়িত বিশ্বের সংগ্রামে রূপান্তরিত হতে পারে।

দ্বিতীয়টি হচ্ছে নদিয়া ও ভাবান্দোলন। জাত-পাত, নারীপুরুষ এবং ধনি-নির্ধন ভেদ বিরোধী যে সংগ্রাম সুলতানী আমলে বৃহৎ বাংলায় শুরু হয়েও ব্যর্থ ও পরাজিত। সেই ইতিহাস নতুন ভাবে বোঝা দরকার। বুঝতে হল তাকে প্রান্তিক ও ক্ষয়িষ্ণু হবার কারণে যে বৈপ্লবিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এই আন্দোলন নদিয়ার প্রথম 'ফকির' শ্রী চৈতনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল, এখন তা প্রান্তিক ও অতিশয় স্থানিক হয়ে রয়েছে। সেখানেও কিছু অসাধারণ ও অভূতপূর্ব জিজ্ঞাসা রয়েছে যাকে সর্বজনীন ও বৈশ্বিক জিজ্ঞাসায় পরিণত করা দরকার।

এই দুটি ক্ষেত্রের কাজ 'মানুষ ও 'পিঁপড়ার' কাজ থেকে আলাদা, কিন্তু সম্পর্কহীন নয়। সেই কারণে শুরুতেই উল্লেখ করে রাখা জরুরী মনে করছি। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গোলকায়িত বিশ্বে স্থানীয় জিজ্ঞাসাকে কিভাবে সর্বজনীন জিজ্ঞাসা ও পর্যালোচনার মুখোমুখী দাঁড় করানো, যাতে বিশ্বসমাজের সদস্য হিশাবে আমরা পাশ্চাত্য চিন্তাকে মোকাবিলা করতে পারি এবং প্রমাণ করে দেখাতে পারি পাশ্চাত্য চিন্তা নিজেকে সর্বজনীন দাবি করলেও আসলে তা নিতান্তই বিশ্বের অন্তর্গত আরেকটি স্থান, মফস্বল বা প্রাদেশিক চিন্তা মাত্র। তার দেশকালপাত্র আছে। পাশ্চাত্যের সঙ্গে আদান প্রদানে আমাদের ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। কিন্তু প্রাদেশিক চিন্তা নিজেকে সর্বজনীন দাবি করে আমাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের যে সংস্কৃতি ও রাজনীতি তা রুখে দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।

নিজেদের স্থানিক জিজ্ঞাসাকে সর্বজনীন ও গোলকায়িত করতে পারা, এই চ্যালেঞ্জ টুকু কাঁধে নিয়েই কাজ করতে হবে।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।